শাহ মো. মিনহাজুর রহমানঃ ৩ অক্টোবর ২০২০ এই দিনে এই নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে মাওলায়ে হাকিকির ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন এক ইনসানে কামিল শায়খুল হাদিস আল্লামা শুয়াইবুর রহমান বালাউটি ছাহেব রহ.। তিনি যেমন ছিলেন আধ্যাত্মিক জগতের রাহবার, ঠিক তেমনি ছিলেন ইলমে শরিয়তের এক আলোকবর্তীকা। তিনি ছিলেন মানবসেবায় নিবেদিত এক মহাপুরুষ। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘সেই মানুষ উত্তম যে মানুষের উপকার করে ‘। আল্লামা বালাউটি ছাহেব রহ.’র জীবনটাই অতিবাহিত হয়েছে মানুষের উপকারে। ২০১৯ সালের ৪ অক্টোবর লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে সম্পন্ন হয় তার জানানা ও কাফন-দাফন। এমন মহান মানুষদের জীবন আলোচনা করে শেষ করার নয়। এই মহা-মনিষীর জীবনী অতি-সংক্ষিপ্তভাবে স্বরণ করছি তার প্রথম ইন্তেকাল বার্ষিকীতে।
জন্ম ও বংশ পরিচয় : সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলাধীন ৩নং কাজলসার ইউনিয়নের অন্তর্গত ঐতিহ্যবাহী বালাউট গ্রামে প্রিন্সিপাল আল্লামা শুয়াইবুর রহমান বালাউটী ছাহেব রহ. এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪৩ সালের মে মাসের ১৫ তারিখ বুজুর্গ পূর্বপুরুষদের রক্ত ধারার গৌরবময় উত্তরাধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। মাতৃকূল এবং পিতৃকূল উভয় দিক দিয়েই প্রিন্সিপাল আল্লামা বালাউটী ছাহেব রহ. শরীফ বা কুলীন। তাঁর পূর্বপুরুষগণ ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক রাজধানী বলে খ্যাত দিল্লীর অধিবাসী ছিলেন। তাঁরা দিল্লী থেকে এদেশের সিলেট খাদিম বসতি স্থাপন করেন। সেখান থেকে তাঁর প্রপিতামহ দুই ভাই হযরত মংলা শাহ্ ছাহেব র. ও হযরত মাওলানা শাহ্ আব্দুল আজিজ ছাহেব র. তৎকালে নদী পথে বালাউট আগমন করেন এবং হযরত মংলা শাহ্ ছাহেব র. দ্বীন প্রচারের নিমিত্তে বালাউটে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর পিতা তাদেরই অধস্তন পুরুষ মরহুম রছমান আলী রহ.।
শিক্ষা জীবন: মহীয়ান পিতা ও মহীয়সী মাতার স্নেহপরশ এবং কড়া তত্ত্বাবধানে পারিবারিক পরিবেশেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের সূচনা হয়। চার বছর বয়সে তার পিতার ইন্তেকাল হয়। তখন ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ্ র. তাঁকে সড়কের বাজার আহমদিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। সেদিন থেকে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। সেখানে দু’বছর জামাতে হাশতম পযর্ন্ত লেখাপড়া করেন। অতঃপর হাড়িকান্দি মাদ্রাসায় জামাতে পাঞ্জম (৫ম শ্রেণী) পর্যন্ত লেখাপড়া করে ১৯৫১ সালে কৃতিত্বের সাথে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করেন।
ঐতিহ্যবাহী ইছামতি দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসায় ১৯৫২ সালে আলিয়া আউয়াল জামাতে (৬ষ্ট শ্রেণীতে) ভর্তি হয়ে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা শুরু করেন। আলিয়া দুওম’র বার্ষিক পরীক্ষায় কোরআন মজীদ ও কাফিয়া-শাফিয়া বিষয়ে সকল প্রশ্নের সঠিক উত্তর প্রদান, নির্ভুল বানান ও সুন্দর হস্তাক্ষরে আকর্ষণীয় লেখনীর দরুন কোরআন মজীদের শিক্ষক মরহুম মাওলানা মতছিম আলী সাহেব অত্যান্ত খুশি হন এবং মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মাওলানা মতিউর রহমান সাহেবকে উক্ত খুশ খবরি জানালে তিনি (কোরআন মজীদ ও কাফিয়া-শাফিয়া বিষয়ে পারদর্শীর দরুন) তা’আজ্জুব হয়ে ষ্টাফ মিটিং করে নির্ধারিত নম্বরের অধিক নম্বর (৫০ এর মধ্যে ৫৫) প্রদান করেও ক্ষান্ত হননি; বরং উক্ত নজরধরা পরীক্ষার খাতাগুলো কৌতূহলীদের দৃষ্টিগোচরের লক্ষ্যে নোটিশ বোর্ডে ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দেন এবং পরবর্তীতে খাতাগুলো মাদ্রাসা লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত রাখেন। ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে সর্বপ্রথম সেন্টার পরীক্ষায় ইছামতি দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসা থেকে অংশগ্রহণ করে আলিম (ফাইনাল) পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬০ সালে একই মাদ্রাসা থেকে ফাজিল (চূড়ান্ত) পরীক্ষায়ও কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। ১৯৬০ সালে ঐতিহ্যবাহী সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসায় কামিল শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে অত্যন্ত সুনামের সাথে অধ্যয়ন করে পাকিস্তান মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ঢাকার অধীনে ১৯৬২ সালে কৃতিত্বের সাথে মাদ্রাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর কামিল (হাদিস বিভাগে) পাশ করেন।
ইলমে কেরাত শিক্ষা ও খেদমত: প্রিন্সিপাল আল্লামা বালাউটী ছাহেব রহ. ইলমে শরিয়ত এবং ইলমে তরীকতের পাশাপাশি ইলমে কেরাতেরও সর্বোচ্চ শিক্ষা অর্জন করেছিলেন। ইলমে কেরাতে তাঁর প্রথম উস্তাদ হচ্ছেন হযরত মাওলানা ক্বারী তজম্মুল আলী রাজাপুরী, (সাতবাখ-কানাইঘাটী) রহ.। দ্বিতীয় উস্তাদ রামপুরী সনদপ্রাপ্ত হযরত মাওলানা ক্বারী আব্দুল গণী কান্দিগ্রামী র. এবং তৃতীয় উস্তাদ হচ্ছেন হাফিজ ক্বারী আশরাফ উদ্দিন ছাহেব র. কাছাড়, ভারত। এরপর তিনি মক্কা শরীফসহ তৎকালীন বিশ্বের খ্যাতিমান ক্বারীগণের উস্তাদ ও পরীক্ষক মিশরীয় বংশোদ্ভুত শায়খুল কুররা হযরত আহমদ হিজাযী মক্কী র.-এর শীর্ষতম সনদপ্রাপ্ত ছাত্র শায়খুল কুররা হযরত আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র.-এর নিকট ইলমে কিরাতের সর্বোচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে সনদ লাভ করেন। তিনি ইলমে কিরাতের সনদ প্রাপ্তির পর থেকে ইন্তেকালের বছর পর্যন্ত প্রতিবছর রামাদ্বান মাসে বিভিন্ন জায়গায় সহিহ কুরআন শিক্ষার প্রশিক্ষণ প্রদান করতেন।
বায়াত ও ইলমে তাসাউফের দীক্ষা ও খেদমত: আল্লামা শুয়াইবুর রহমান বালাউটি ছাহেব রহ. ছাত্র জীবনেই শাহ সূফি ইয়াকুব বদরপুরী রহ.’র নিকট বায়াত গ্রহণ করেন। তাঁর ইন্তেকালের পর আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব রহ.’র হাতে বায়াত লাভ করেন এবং কামালিয়ত হাসিল করে ১৯৭১ সালে খেলাতফ লাভ করেন। তিনি স্বীয় মুর্শিদের নির্দেশে বহুবার পাহাড়ে নির্জন-বাস করেন। এবং পরবর্তীতে নিজের মুরিদানকে নিয়ে কয়েকবার নির্জন-বাসে যান। তিনি সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় খানেকা প্রতিষ্ঠা করেন।
ইলমে দ্বীনের খেদমত: ১৯৬০ সালে ফাজিল ফাইনাল পরীক্ষার পর আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ্ (র.)-এর নির্দেশে প্রমুদিত হয়ে তৎকালীন বাদেদেওরাইল ফুলতলী আলিয়া মাদ্রাসায় খন্ডকালীন শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনের (দ্বীনি-খেদমতের) সূচনা হয়। ১৯৬২ সালে কামিল ফাইনাল পরীক্ষার সমাপনের পর বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদ্রাসায় প্রথমে কিছুদিন সহকারী শিক্ষক পদে চাকুরী করার পর ১ মে ১৯৬২ হতে ৪ নভেম্বর
Leave a Reply